ব্লগ লেখার কল্যাণে মালয়েশিয়া ভ্রমণ, পর্ব-৪

কুয়ালা লামপুরের অলিতে গলিতে ঘুরাঘুরি

S M Sarwar Nobin
7 min readApr 3, 2020

মালয়েশিয়া বা কুয়ালা লামপুর এর আইকনির স্থাপনা ছাড়াও বেশ কিছু টুরিস্ট স্পট আছে যা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। সে গুলো পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষনীয় টুরিস্ট স্পট।

আর হ্যাঁ আজকের পর্বের শুরুতেই বলব কিভাবে এবার Petronas Twin Towers এর tower bridge এর টিকিট যোগাড় করেছিলাম। শুরুতে ২৬ শে ফেব্রুয়ারিতে একটা চেস্টা করে ছিলাম টিকিট কেনার। হোটেল থেকে বের হই ঠিক সময়ই সকাল ৮ টার দিকে। কিন্তু জ্যামের জন্য ৯ টা পার হয়ে যায় পৌঁছাতে। তাও গিয়েছিলাম কিন্তু দুঃখ পিক সময়ের টিকিট পাই নাই। পিক সময় হল দুটো ঠিক সূর্যাস্তের আগের সময়। ২০১৯ এর এপ্রিলে যখন গিয়েছিলাম তখন ছিল 6/6:15 pm এর আমি সে বার 6:30 pm এর টিকিট নিয়েছিলাম। কারণ এ সময় সূর্যাস্তের অপরূপ সুন্দর দৃশ্য টি দেখা যায়। এবার অবশ্য পিক সময় ছিলো 7/7:15 pm। ২৬ শে ফেব্রুয়ারিতে পেলাম না। চলে গেলাম মনের দুঃখে।

আমরা আর কদিন কুয়ালা লামপুর এ থাকব সে চিন্তা ছিলোই তাই এবার মালাক্কা থেকে এসে ২৯ শে ফেব্রুয়ারিতে চেস্টা করলাম। এবার আর grab এ আসি নাই হোটেল থেকে। Monorail আর MRT ব্যবহার করে প্রায় ১০ মিনিটের ভিতর ই চলে আসছি। একটু লাইন ছিলো। তবে এবার পেলাম 7:15 pm এর টিকিট। টিকিট পাওয়া কষ্টকর এই দুসময়ের কারণ অনেক এজেন্সির লোক জন ১০-২০ টা করে টিকিট নেয়। আমি এর প্রতিবাদ স্বরূপ কাউন্টারে বলেছিলাম ও কিন্তু লাভ নাই কতৃপক্ষ এটা বন্ধ করে না। ওকে এবার RM 80 করে ২ টা টিকিট নিলাম। আমার ছোট ভাই ঘুমায় আমি এসব করি আর কি =D টিকিট কেটে হোটেলে ফিরে সকালের নাস্তাটা করে নিলাম।

এরপর শহর টা দেখতে বের হলাম। আমার ছোট ভাই আজ বের হবে না সে সারা দিন ঘুমায়ে সন্ধ্যায় টাওয়ারে উঠবে। কারণ ও বেশ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো। আমি আবার ঘুরতে গেলে ক্লান্ত হওয়ার ধার ধারি না।আমার এটাই সুযোগ আমি বলে দিলাম ওকে সারা দিন তাহলে আমার মত করে ঘুরব। আমি বেরিয়ে পড়লাম।

আমার গত বছর থেকেই ইচ্ছা কুয়ালা লামপুর পথে ঘাটে টো টো করে ঘুরে বেড়ানো আর ওদের ঐতিহাসিক টুরিস্ট স্পট গুলো দেখা। আজকের দিনে প্রথম টার্গেট করলাম Masjid Jamek। এটা মালয়েশিয়ার অন্যতম একটি সুন্দর মসজিদ। Gombak আর Klang নদীর পাশে Masjid Jamek। Masjid Jamek ভারতীয় মুঘল স্থাপত্যশৈলী তে নকশা করা।

Me with Mr. Hafez

Masjid Jamek এ এসে Mr. Hafez নামে এক স্বেচ্ছাসেবকের সাথে পরিচয় হয়ে গেলো। সে একটি ব্রিটিশ কোম্পানিতো চাকরি করে। আর অবসর সময় পেলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা তে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে বিভিন্ন বিদেশী পর্যটকদের ঐ স্থাপনা সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে। এখানে না আসলে জানতাম না এভাবেও মানব সেবা করা যায়।

তবে আরেকটি বেদনাদায়ক তথ্য দিয়ে রাখি। আমরা হয়ত অনেকেই কম বেশি মালয় ভাষা দেখি যা ইংরেজি বর্ণের বা অক্ষরের। দুঃখজনক হলেও সত্য মালয়দেরও আরবী ধরণের নিজস্ব বর্ণমালা ছিলো। কালের পরিক্রমায় আজ তা তারা হারিয়ে ইংরেজি বর্ণমালা ব্যবহার করে। অনেকটা আমাদের বাংগালিশ ভাষার মত। তাই আমি সন্দিহান বাংলা ভাষার ভবিষ্যত নিয়ে। আমরা ডিজিটালি বাংলা কিবোর্ড দিয়ে টাইপ করি না। অভ্র দিয়ে করি। আমি অভ্রকে খারাপ বলছি না। কিন্তু কালের বিবর্তনে হয়ত আমাদের বাংলা ভাষার অক্ষরগুলো হারিয়ে বাংগালিশ হলেও তখন হয়ত কিছু করার থাকবে না! আজ থাক সে আলাপ। আগাই পরবর্তী গন্তব্যে।

মসজিদ জামেক থেকে বের হয়ে গেলাম Dataran Merdeka তে। Dataran Merdeka হল Sultan Abdul Samad Building এর সামনে। এটা আসলে মালয়দের স্বাধীনতা চত্বর বলা হয়। Sultan Abdul Samad Building এখন সংরক্ষিত ঐতিহাসিক ভবন হিসাবে পর্যটকদের মন ভোলায়। Dataran Merdeka তেই আছে বিশ্বের সর্বোচ্চ উঁচু ৩১২ ফিট লম্বা Flag port। যেখানে পত পত করে উড়ছে মালয়েশিয়ার পতাকা।

World’s highest flag port

Dataran Merdeka থেকে বেরিয়ে ঢুকে পড়লাম Kuala Lumpur City Gallery তে এখান কার admission fee RM 10 আর সাথে RM 5 এর একটি ভাউচার পাওয়া যায় কেনা কাটা করার জন্য।Kuala Lumpur City Gallery তে ঢুকলে দেখা যাবে পুরো সিটি ম্যাপ। সিটিতে সবচেয়ে বড় বড় বিল্ডিং গুলোর Replica সব কিছুই আছে এতে। এখানে সুন্দর একটা শো হয় এতে পুরা শহরের স্থাপনা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে।

Geleri Kuala lumpur

ভিতরে কিছু সুন্দর ছবি এখানে তুলে ধরলাম আমি। অনিন্দ্য সুন্দর একটা গ্যালারি। গ্যালারি শেষে সুন্দর বিশাল একটি suvenior shop ও আছে। অনেক কিছু কিনতে পারবেন এখান থেকে।

Geleri Kuala lumpur থেকে বের হয়ে রাস্তার বিপরিতে Muzium Tekstil Negara (National Textile Museum)। আমি আবার এসব মিউজিয়ামে ঘুরতে বেশ পছন্দ করি। RM 5 দিয়ে একটি টিকিট কিনে ঢুকে পড়লাম। ঘন্টা কয়েক ঘুরে আরাম রেস্ট নিতেও ভুললাম না। পুরো মিউজিয়াম জুরেই ছিলো মালয়েশিয়ার পোশাক শিল্প নিয়ে খুঁটি নাটি। সে বলে শেষ করা যাবে না এক দু লাইনে। এই মিউজিয়াম টা 9:00 am-6:00pm পর্যন্ত খোলা থাকে। ইতিহাস ঐতিহ্য এসব নিয়ে জানতে এসব মিউজিয়াম এ ঢু মারতে ভুলবেন না।

Masjid Negara Malaysia

National Textile Museum থেকে বের হয়ে একটু দূরে হেঁটে গেলেই Masjid Negara Malaysia (National Mosque of Malaysia)। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য উদাহারণ এই মসজিদ নিগারা। পুরো মসজিদটা ঘুরে ঘুরে দেখতে পারেন। মুসলমান হলে নামাজও পড়ে নিতে পারেন। প্রচুর বিদেশী মানে সাদা চামড়ার লোকজন এখানে আসে মসজিদটি এক নজর দেখতে। যদিও নামাজের মত দর্শনার্থীদের জন্য মসজিদটি বন্ধ থাকে। আপনি মুসলমান হলে এসময় নামাজ পড়তে পারেন।

মসজিদ নিগারা থেকে বের হয়ে grab নিয়ে চলে গেলাম হোটেলে। MRT ধরে যেতে বেশ কিছু পথ হাঁটতে হত। যা তখন শরীরে কুলায় নি। প্রচন্ড রোদের তাপ। যা আমার মত নতুন মানুষজনের কাছে বেশ কষ্টকর।

হোটেল এ কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে এবং দুপুরে খাবার সেড়ে নিয়ে আবারও বের হয়ে পড়লাম Batu Caves এর উদ্দেশ্যে। Batu Caves মালয়েশিয়ার Gombak, Selangor এলাকায় অবস্থিত। Batu Caves এ সবচেয়ে সস্তায় যাওয়ার উপায় আমি আজ বলব। কুয়ালা লামপুর শহরের যেখানেই থাকেন না কেন আপনি MRT তে করে KL Sentral স্টেশনে চলে আসবেন। KL Sentral থেকে Batu Caves এ Port Klang Line এর ট্রেন আছে। ভাড়া পড়বে মাত্র RM 2.60 জন প্রতি। আপনি KL Sentral স্টেশনে কাউকে Batu Caves যাওয়ার কথা বললেই বলে দিবে ট্রেনের কথা। যদি ট্রেন টা MRT বা মনোরেলের মত অত দ্রুত না। 15 km যেতেই প্রায় ২০-২৫ মিনিট সময় নেয়। গরুর গাড়ি মার্কা ট্রেন তবে সেই রকম সুন্দর ট্রেন। সস্তায় যেতে চাইলে এটার বিকল্প নাই। বিশেষত নতুন পর্যটকদের জন্য।

Batu Caves অনেক সুন্দর একটা মন্দির। Batu Caves এর মূল আকর্ষণ Lord Murugan Statue এটি 42.7 m উঁচু এবং বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম মূর্তি। লর্ড মুরুগান এর পাশেই রয়েছে ২৭২ ধাপের এক দীর্ঘতম সিঁড়ি। যা পেড়িয়ে মূল মন্দিরে যেতে হয়। আমি কিছুটা চ্যালেঞ্জ হিসাবেই নিয়েছিলাম। শুনেছি অনেক পর্যটক নাকি এই সিঁড়িতে উঠার ভয়ে মন্দিরে যান না। আমি কষ্ট করে হলেও শেষ মেশ উঠেছিলাম। উঠে দেখি সে কি এক বিশাল গুহা! আমার জীবনে এখন পর্যন্ত দেখা সবচেয়ে বড় গুহা।

Me at Batu Caves

যদিও নামার সময় এক মজার ঘটনা ঘটে। আমি কোন কারণে আমার কাঁধের ব্যাগটি নিচু করে ছিলাম। ব্যাস অমন একটা বাঁদর মশাই আমার পানির বোতল নিয়ে দৌড়। কি আর করার মন খারাপ করে নিচে নেমে কিছু ছবি তুলতে ভুললাম না। প্রচুর কবুতর আছে নিচে। এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।

Batu Caves থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ৭ টা বেজে পার হয়ে গেল। হোটেলে ফিরতে ৮ টা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বের হলাম Jalan Alor রোডে রাতের পসরা দেখতে। রাতে আড্ডা দিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত ১২ টা বেজে পার। এবার ঘুম দেওয়া যাক।

পরের দিনের পরিকল্পনা ছিলো Putrajaya তে যাওয়ার কিন্তু আমার ছোট ভাই কিছুটা অসুস্থ আমিও পায়ে ব্যথা অনুভব করছিলাম আমিও গেলাম না। পরে বিকালে বের হলাম KL Bird Park দেখতে। এখানে admission fee ছিলো‌ জনপ্রতি RM 63। যদিও আমাদের টাকাটা অর্ধেক ই বৃথা। আসলে আমি জানতাম না Bird Park এ বিভিন্ন শো এর টাইম থাকে। তাই আমি সবার সুবিধার্থে তাদের সাইটের লিঙ্ক জুড়ে দিলামঃ klbirdpark.com/visitordetail/Daily_Activities যাওয়ার আগে এখানে সময় দেখে যাবেন। বিশেষত ১০ টার দিকে গেলে সব কিছুই উপভোগ করতে পারবেন। তবে আমার কিছু ছবি তুলতে ভুল করি নাই। বিশেষত আমি।

Me at KL Bird Park

সকালে আসলে সারাদিন আশেপাশের বিভিন্ন পার্কে ঘুরে বেড়াতে পারবেন যদিও পুরো এলাকা একদিন কভার করা সম্ভব না। আশে পাশে Kuala Lumpur Butterfly Park, Deer Park, KL Forest Eco Park, Orchid & Hibiscus Gardens, Royal Malaysian Police Museum, Malaysian Houses of Parliament, National Monument সহ বেশ কিছু স্থাপনা আছে। আমরা সময় অভাবে এত কিছু ঘুরতে পারি নাই।

তবে এখান থেকে সন্ধ্যায় ফিরলাম China Town এর Petaling Street Market। এখান থেকে সস্তায় যদিও দামা দামি করতে হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য এখানে প্রচুর বাংলাদেশী ভাইয়ের দোকানি আছে কিন্তু তারা আপনি দেশী মানুষ শুনলে আরও দুই হরফ দাম বেশি রাখে। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা। Petaling Street Market দেশের নিউ মার্কেটের মত। তবে বেশ সুন্দর। অনেক মালয়েশিয়ান স্থানীয় খাবারও পাওয়া যায়। তবে জিনিস পত্র হিসাবে ব্যাগ, কাপড়, Twin Tower এর Replica সহ বিভিন্ন জিনিস পাওয়া যায় এখানে। তবে কিছু কিছু দোকান আছে Fixed Price এর সেগুলোতে ট্যাগ লাগানোই থাকে তবে সেগুলো বড় স্থায়ী দোকান।

আপাতত এবারের মত কুয়ালা লামপুরে ঘোরা শেষ। পর দিন লংকাউই এর ফ্লাইট ছিলো। আগামী পর্ব লিখব লংকাউই নিয়ে। লংকাউই এ কখনও না গেলেও ব্লগটা পড়েন। অসম্ভব সুন্দর একটি দ্বীপ।

বাকি পর্ব গুলে পড়তে এখানে ঢু মারতে পারেন।
পর্ব ১ঃ bit.ly/kl-part1 (কুয়ালা লামপুরে সামান্য ঘুরাঘুরি)
পর্ব ২ঃ bit.ly/gn-part2 (স্বপ্নপুরি Genting Highlands নিয়ে গল্প সপ্প)
পর্ব ৩ঃ bit.ly/ml-part3 (মালাক্কার পথে প্রান্তরে)
পর্ব ৫ঃ bit.ly/lk-part5 (দ্বীপ পুরি Langkawi চষে বেড়ানো)
পর্ব ৬ঃ bit.ly/kl-part6 (মালয়েশিয়া ঘুরব, নিজেই ট্যুর প্যাকেজ বানাব)

--

--

S M Sarwar Nobin

Graduate Research Assistant at UTRGV, USA and Freelance Email Signature Developer